ব্রেকিং

x

ভালোবাসা দিবস: আবেগ অনুভূতি প্রকাশে কেউ কেউ কেন কার্পণ্য করেন?

সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১০:৫৮ অপরাহ্ণ | 99 বার

ভালোবাসা দিবস: আবেগ অনুভূতি প্রকাশে কেউ কেউ কেন কার্পণ্য করেন?
প্রতীকী ছবি

মনের মানুষের সাথে সবাই এমন ছবি তুলতে পারেন না–কেবল প্রকাশের অক্ষমতায়

ভালোবাসার প্রকাশ একেক সংস্কৃতিতে একেক রকম হয়। পাশ্চাত্য দেশীয়রা প্রকাশ্যেই যেমন ভালোবাসার প্রকাশ ঘটান, প্রেয়সী, বন্ধু বা পরিবারের মানুষজনকে জড়িয়ে ধরেন, ভালোবাসার মানুষের মুখে এঁকে দিতে পারেন প্রেম চুম্বন, প্রাচ্যের দেশ বা নির্দিষ্ট করে বললে বাংলাদেশে তেমনটা খুব একটা দেখা যায় না।



আবেগ অনুভূতির প্রকাশ যেমন নেই, আবার কদাচিৎ দেখে গেলেও তা ভীষণ সমালোচনায় পড়ে।

বছর কয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৃষ্টি ভেজা এক বিকেলে চুম্বনরত এক যুগলের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।

সামাজিক মাধ্যমে সেই ছবিকে কেউ কেউ বাহবা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ছবির পাত্র-পাত্রী আর ছবিটি যিনি তুলেছিলেন তাদের সমালোচনাও হয়েছিল বিস্তর।

তাদের বিরুদ্ধে ‘সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য’ কাজ করার অভিযোগ তোলা হয়েছিল।

কিন্তু তা বলে ব্যাপারটা মোটেও এমন না যে এ দেশের লোকে ভালোবাসে না, বা তাদের আবেগ অনুভূতিতে কোন সমস্যা আছে। বরং আবেগ বেশি বলে বাঙ্গালির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়।

* চুম্বনের ভাইরাল সেই ছবি নিয়ে বিতর্কের ঝড়

* ‘আমি ট্রান্সজেন্ডার, আর আমার প্রেমিক একজন স্ট্রেইট পুরুষ’

সমস্যা কেবল অনুভূতির প্রকাশে।

আর এ সমস্যা কেবল কিউপিডের শরবিদ্ধ প্রণয় প্রত্যাশী লোকের নয়। মা-বাবা সন্তানের সামনে নিজেদের স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ ঘটান এমন উদাহরণ এ সমাজে বিরল।

বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের নমুনাও কম, বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে বন্ধুত্ব হলে অনুভূতি প্রকাশ কদাচ নয়।

হেরে যাওয়া এক ব্যর্থ মানুষ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভাগের এক ছোট বোনের প্রেমে পড়েছিলেন দেশীয় একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা রুবাইয়াৎ ইসলাম। এটি তার আসল নাম নয়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে তার নামটি বদলে দেয়া হয়েছে।

বিবিসিকে তিনি বলেছেন, মেয়েটির সাথে পরিচয় হবার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ছিলেন তিনি, কিন্তু কোনদিনই তাকে বলতে পারেননি নিজের অনুভূতির কথা।

তিনি বলছেন, “অথচ বন্ধুত্বের সম্পর্কই ছিল ওর সাথে। একসাথে বিতর্ক করতাম আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট ক্লাবে। সমাজ, রাজনীতি, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, রেজাল্ট ভালো করার উচ্ছ্বাস, চাকরি না পাবার হতাশা—কত বিষয়ে কথা হয়েছে! খালি এই কথাটাই কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি।”

মেয়েটির যখন প্রেম হয়েছিল অন্য একজনের সাথে, কষ্টে সারারাত নির্ঘুম কেটেছিল রুবাইয়াতের। নিজেকে তার হেরে যাওয়া ব্যর্থ মানুষ মনে হচ্ছিল।

সেই অনুভূতির কথাও তিনি জানাতে পারেননি মেয়েটিকে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনোর ১২ বছর পরে মেয়েটির সাথে একদিন কথা হয় রুবাইয়াতের। ততদিনে তারা দুইজনই পেশা ও সংসারে থিতু মানুষ। দুইজনই বিয়ে করেছেন, একই সেক্টরে কাজ করেন।

সেদিন রুবাইয়াৎ তরুণ বয়সের অনুভূতির কথা মেয়েটিকে বলে দেন। মেয়েটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, “আপনি বলেননি কেন? আমার তো আপনাকে অনেক পছন্দ, আপনি বললেই আমি রাজি হয়ে যেতাম।”

কষ্টের হাসির সাথে একটা দীর্ঘশ্বাসও ছিল সেই বৈঠক শেষের মূহুর্তে।

অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কা
শামীমা সুলতানা নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, অনুভূতি প্রকাশ করে সামাজিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ার বা অপদস্থ হবার আশংকা বোধ করেন তিনি।

তিনি বলছেন, “ধরেন খুশীতে একজন বন্ধুকেও জড়িয়ে ধরতে ভয় লাগে, কেউ না আবার বলে বসে অসামাজিক কাজ করছি। আমার মনে তার চেয়ে এটাই ভালো যে কোন ফিলিংসই প্রকাশ করবো না।”

আর পরিবারেও বিষয়টা খুব ব্যতিক্রম নয় বলে তিনি জানান।

“আমি এসেছি একটা মফস্বল শহর থেকে সেখানে বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আবেগ প্রকাশ করে না, আমিও শিখি নাই। কিন্তু আমি যখন দিনাজপুর ছেড়ে ঢাকায় পড়তে এসেছিলাম আমার বাবা আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলেন। আমার ইচ্ছা করছিল আব্বাকে জড়িয়ে ধরি, পারি নাই সবাই কী ভাববে, সেটা ভেবে।”

শামীমার বাবা মারা গেছেন গত বছর।

“আমার সারাজীবন আফসোস থাকবে কেন আব্বাকে জড়াই ধরে বললাম না কত্ত কষ্ট হইছিল তাকে ছেড়ে আসতে।”

বেঁচে থাকার প্রেরণা হারানো এক নারী
এই গল্পটি একজন ষাটোর্ধ নারীর। যিনি তুখোড় মেধাবী ছাত্রী ছিলেন স্কুলে। কিন্তু চিন্তায় কিংবা অর্থনৈতিকভাবে তার পরিবার তেমন অগ্রসর ছিল না, ফলে মেট্রিক পাসের পরই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছিল।

* বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন যেভাবে শুরু

* একইদিনে পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন’স ডে, বিপাকে ব্যবসায়ীরা

স্বামীর পরিবারে গিয়ে ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করেছেন তিনি।

কিন্তু কোনদিন অভিযোগ করেননি বা ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেননি বলে শ্বশুরবাড়িতে তার সুনাম আছে।

এই মহিলার বয়স যখন ৫২ বছর তখন তার ক্রনিক ডিপ্রেশন ধরা পড়ে। চিকিৎসক বলেছিলেন সুস্থ থাকার কিংবা বেঁচে থাকার কোন প্রেরণা নেই এই নারীর ভেতরে।

এখন তাকে মাসে দুইদিন মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে হয়, কাউন্সেলিং এর জন্য।

তিনি বলেছেন, “আমার বিয়ের সময় আমার দাদী বেঁচে আছেন, তিনি বলেছিলেন ‘অভিযোগ করবা না, নালিশ করবা না, কারো পিছে বদনাম করবা না—তাহলে সুখী হইতে পারবা।’ আমি এটাই মেনে চলেছি, কষ্ট পেলেও কাউকে বলি নাই, আঘাত পেলে সহ্য করে গেছি।”

প্রত্যাখ্যানের ভীতি
সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রত্যাখ্যানের ভীতি, সামাজিক অসম্মানের ভয় বা অন্যের চোখে দুর্বল বা হেয় হয়ে যাবার ভয় থেকেই সাধারণত মানুষ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে দ্বিধা বা সংকোচ বোধ করেন।

তবে সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এর পেছনে শতশত বছরের চর্চা হওয়া মূল্যবোধ, যা মূলত রক্ষণশীল। তারা আরো কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো নিচে বর্ণনা করা হচ্ছে:

বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না
বাংলা ভাষায় বহু পুরনো এক প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না’—এর মানে হচ্ছে যত কষ্টই হোক তা প্রকাশ না করা।

প্রাথমিকভাবে এ প্রবাদ নারীর মানস বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হলেও, পুরুষও যে অভিব্যক্তি প্রকাশে খুব এগোনো তা নয়।

শত শত বছর ধরে নিজের অনুভূতির প্রকাশ না করে নিজের মধ্যে চেপে রাখাই যেন বাঙালীর সামাজিক আদব-কেতা প্রমাণের মানদণ্ড।

এর প্রমাণ মেলে যখন সারা দুনিয়ার মত বাংলাদেশেরও অনেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস পালন করছেন, সেই সকালেও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একাধিক দৈনিক পত্রিকা, ওয়েবসাইট এবং সামাজিক মাধ্যমে ‘ভালোবাসি কথাটি মুখে না বলে যেভাবে প্রকাশ করবেন’ ধরণের শিরোনামে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

অর্থাৎ অন্য আবেগ অনুভূতির বাদ দিন, ভালোবাসার অনুভূতিটাও মুখে বলে প্রকাশ করতে চান না এমন মানুষের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

বিশ্লেষকেরা মনে এর পেছনে প্রথম ও প্রধান কারণটি সাংস্কৃতিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম মনে করেন, সাংস্কৃতিকভাবে প্রাচ্য দেশীয় মানুষ আবেগ প্রকাশ করতে শেখেন না।

“গত দুই দশকে শহুরে শিক্ষিতদের মধ্যে অনুভূতি প্রকাশের বিষয়টি বদলাচ্ছে, কিন্তু সেটাকে এখনো সার্বজনীন পরিবর্তন বলা যাবে না। সাংস্কৃতিকভাবেই এখানকার মানুষকে ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করতে শেখানো হয় না। বরং সেটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়।”

সামাজিক রক্ষণশীলতা
অনুভূতি প্রকাশ না করার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, এখানকার সংস্কৃতি রক্ষণশীল। আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, শতশত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ সামাজিকভাবে যে নম্রতা ভদ্রতার চর্চা করে, তাতে নিয়ন্ত্রিত আচরণ করার প্রতি সব সময়ই জোর দেয়া হত।

যে কারণে কেবল ভালোবাসার অনুভূতি নয়, রাগ ক্ষোভ বা হতাশার প্রকাশ বড় পরিসরে না করার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাসরীন ওয়াদুদ বলছেন, “অনুভূতির প্রকাশকে এখানে দুর্বলতা ভাবা হয়। ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় যে তুমি কথা কম বলবে, নিজের মনের ভাবটি কারো সাথে শেয়ার করবে না।

মনের ভাব আরেকজন জেনে গেলে আমি দুর্বল হয়ে যাব এমনটাই শেখানো হয়।”

এছাড়া সামাজিক কারণে অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়।

সামাজিকভাবে প্রচলিত ভালো মেয়ের সংজ্ঞায় দেখা যায় যে শান্ত-শিষ্ট, নম্র, মুখরা নয় এমন কাউকে বোঝানো হয়। যে মনের কথা বলে ফেলে, তাকে বাচাল বা মুখরা আখ্যা দেয় চারপাশের মানুষ।

আবার স্বামী-স্ত্রীও নিজেদের আবেগ প্রকাশ্যে তো নয়ই, এমনকি সন্তানের সামনেও ভালোবাসা প্রকাশ করেন না।

ফলে সন্তানও শেখে বিষয়টি হয়ত স্বাভাবিক নয়।

আবার সন্তানের প্রতি মমতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও কার্পণ্য দেখা যায়।

প্রচলিত ধারণা এমন যে এতে সন্তান বেশি ‘প্রশ্রয়’ পাবে, তারা ‘আস্কারা’ পেয়ে গেলে ‘বখে’ যাবে।

সচেতনতার অভাব
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশই কেবল নয়, আবেগ অনুভূতির প্রকাশ না ঘটিয়ে চেপে রাখা যে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর সে সম্পর্কে জানেন খুব কম সংখ্যক মানুষ।

কারণ এই অনুভূতি চেপে রাখা বা প্রকাশ না করার মাধ্যমে অ্যাংজাইটিসহ নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হবার আশংকা রয়েছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমনকি শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে না অনেকে।

অথচ সেটি প্রকাশ করলে হয়ত নিপীড়ন বন্ধের ব্যবস্থা নিতে পারতেন একজন অভিভাবক।

অনুভূতি প্রকাশ না করে চেপে রাখলে কী হয়?
অনুভূতি প্রকাশের বিষয়টি পুরোপুরি মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, সুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।

অধ্যাপক নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, “পুরো সমাজে যদি সুস্থতা প্রত্যাশা করি আমরা তাহলে সবার মধ্যে সেটি মানে অনুভূতি প্রকাশের গুরুত্বটা তুলে ধরতে হবে।

সমাজে এখন একটি পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শহরে এবং শিক্ষিত লোকের মধ্যেই এখনো সেটা দেখা যাচ্ছে। গ্রামে কিন্তু এখনো পরিস্থিতি এমন নয়।”

সেজন্য তিনি পাঠ্যক্রমে মনোবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা এবং স্কুল কলেজে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের বিষয়টি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবার পরামর্শ দেন।

এদিকে, সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আত্মহত্যা, বিষণ্ণতা, শিশু-কিশোরদের মধ্যে সহিংস আচরণ, ধর্ষণসহ সমাজের নানাবিধ সমস্যার সাথে মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার সম্পর্ক আছে।

নামাজের সময়সূচি

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:১৭ পূর্বাহ্ণ
  • ১২:০১ অপরাহ্ণ
  • ৪:৩০ অপরাহ্ণ
  • ৬:২৬ অপরাহ্ণ
  • ৭:৪৩ অপরাহ্ণ
  • ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

Development by: webnewsdesign.com