শিশু মরিয়ম আক্তারের বয়স মাত্র ১০। করতো ভিক্ষাবৃত্তি। বিভিন্ন বাসে উঠে চাইতো অর্থ সহায়তা। এই শিশুর লাশ গত ৯ নভেম্বর পড়েছিল রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের বিপরীত পাশে। এরপর থেকে শুরু হয় জল্পনা। কীভাবে শিশুটি লাশ হলো। তার রক্তাক্ত শরীর দেখে পুলিশ ধারণা করেছিল, সড়ক দুর্ঘটনার। তবে কোন বাসের নিচে পড়ে সে মারা গেছে, তা জানা যাচ্ছিল না। শুরু হয় অনুসন্ধান।
৫০টির বেশি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করেও কোনো ফুটেজ না পাওয়ায় ঘাতক চালক ও হেলপারকে শনাক্ত করতে গোয়েন্দা কার্যক্রম-নজরদারি আরও বাড়ানো হয়। এরপরই পৃথক অভিযান চালিয়ে গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গী এলাকা থেকে চালক রাজু মিয়া ও হেলপার ইমরান হোসেনকে গ্রেফতার করে র্যাব। তারা উত্তরাগামী রাইদা পরিবহনের বাসের চালক ও হেলপার।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, নিহত মেয়েটি ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। ঘটনার দিন সে সাহায্য চাইতে বাসটিতে উঠেছিল। হেলপার তখন তাকে ‘গেটলক বাস’ বলে বাস থেকে তাকে ফেলে দেয়। ঘটনাস্থলেই মরিয়মের মৃত্যু হয়। হামলা, ভাঙচুরের ভয়ে চালক দ্রুত বাস চালিয়ে ঘটনাস্থল ছেড়ে যান। ফিরতি যাত্রার সময় তারা জানতে পারেন, শিশুটি মারা গেছে। পরে গ্রেফতার এড়াতে তখন গাড়িচালক ও তার সহকারী আত্মগোপনে চলে যান।
এ ঘটনায় শিশুটির বাবা রনি মিয়া অজ্ঞাতপরিচয় চালককে আসামি করে ভাটারা থানায় মামলা করেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘মরিয়ম তার পরিবারের সঙ্গে খিলক্ষেতের কুড়াতলী এলাকায় বসবাস করত। তার বাবা রনি একজন প্রাইভেটকারচালক। মরিয়ম ২০১৯ সালে স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তবে, অর্থের অভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সে বিভিন্ন জায়গায় অর্থ সহায়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুড়িল ও আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরি করত। ঘটনার দিন সকালে মরিয়ম বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পথচারী ও বাস যাত্রীদের কাছে ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাচ্ছিল।’
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ অনুযায়ী তিনি বলেন, ‘দেখা গেছে মরিয়ম হেঁটে হেঁটে ফুটওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে যমুনা ফিউচার পার্কের বিপরীত পাশে আসে। এরপর সে রাইদা সিটিং সার্ভিসের একটি বাসে ওঠে। বাসটি সামনে যেতেই একজন পথচারীকে হাত দিয়ে ইশারা করতে থাকে। সিসিটিভি ক্যামেরার এক ফ্রেমের ঠিক পেছনে ভিকটিম মরিয়মকে আহতাবস্থায় পাওয়া যায়। সিসিটিভি ক্যামেরার অবস্থান এবং সময় বিবেচনা করে নিশ্চিত হওয়া যায়, এখানেই মৃত্যু হয় শিশু মরিয়মের।’
তিনি আরো বলেন, ‘অর্থ সহায়তা চাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসটিতে উঠেছিল মরিয়ম। কিন্তু ভিকটিমের বাসে উঠা এবং পড়ে যাওয়ার কোনো সিসিটিভি ফুটেজ না পাওয়ায় ঘাতক চালক এবং হেলপারকে শনাক্ত করতে গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং নজরদারি আরও বাড়ানো হয়। এরপরই পৃথক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়। তারাই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন।’
গ্রেফতার দুইজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘চালক রাজু মিয়া এবং হেলপার ইমরান হোসেন প্রতিদিনের মতই রাইদা পরিবহনের বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৯০২২) নিয়ে পোস্তগোলা থেকে দিয়াবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকালে স্বল্প সংখ্যক যানবাহন ও যাত্রী কম থাকায় তারা দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। বাসটি প্রগতি সরণি যমুনা ফিউচার পার্কে পৌঁছালে মরিয়ম বাস যাত্রীদের কাছে সাহায্য চাইতে গাড়িতে ওঠে। হেলপার ইমরান এ সময় যাত্রীদের কাছে ভাড়া নিচ্ছিলেন। ইমরান তখন চালককে শিশুটিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চালক রাজুকে গাড়ির গতি কমাতে বলেন। এ সময় মরিয়মকে দরজার কাছে গিয়ে নেমে যেতে বলা হয়। চালক রাজু কিছুদূর না যেতেই আবার থামতে বলায় বিরক্তিতে বাসের গতি হালকা কমিয়ে, মরিয়মকে তাড়াতাড়ি নামতে বলে। মরিয়ম তাড়াহুড়ো করে নামার সময় হঠাৎ বাসচালক জোরে চালানো শুরু করেন। এতে মরিয়ম বাসের দরজার থেকে ছিঁটকে রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে চালক গাড়ি না থামিয়ে দ্রুতবেগে দিয়াবাড়ির দিকে চলে যায়। এরপর পোস্তগোলায় হাসনাবাদের একটি বাস ডিপোতে গাড়িটি রেখে, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়টি কাউকে না বলে আত্মগোপনে চলে যাযন।’
গ্রেফতার চালক রাজু ৬ বছর ধরে রাইদা পরিবহনে গাড়ি চালাতেন। আর তার সহযোগী (হেলপার) ইমরান হোসেন আগে গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ৬ মাস আগে ইমরান রাইদা পরিবহনে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, বাসটি গেটকল সার্ভিস ছিল। তাই মেয়েটিকে হেলপার প্রেসার করেছিল, যেন দ্রুত নেমে যায়। নিহত মরিয়ম বাস থেকে নামানোর সময় বাসের গতি ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এতে সে বাস থেকে রাস্তায় পড়ে মারা যায়।
এদিকে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না, এমন প্রশ্নে কমান্ডার আল মঈন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি।
Development by: webnewsdesign.com