অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে আজ সংবাদপত্রের উজ্জ্বল ভূমিকা পালনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে খবর সংগ্রহ ও পরিবেশনের চেয়েও বেশি কিছু করার। কারণ, বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্র যথাযথভাবে কার্যকর আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। গণতন্ত্রের অনেকগুলো শর্ত, যেমন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, জবাবদিহি ও বিরোধী দল, নির্ভয়ে কথা বলা ও লেখার স্বাধীনতা এখন এখানে অনুপস্থিত। সব শর্ত সংবাদপত্র পূরণ করতে পারে না। কিন্তু বিরোধী দলের ভূমিকাটা কিছুটা হলেও সংবাদপত্রগুলোর পক্ষে পালন করা সম্ভব। আর সম্ভব মানুষের কথা শোনানোর ব্যবস্থা করার। কারণ, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের গল্প ও আর্তনাদ শোনার কেউ নেই। প্রথম আলোকে, দেখছি, কয়েক মাস যাবৎ মতামত বিভাগে নিয়মিত পাঠকের চিঠি প্রকাশ করছে। এটা একটা ভীষণ উপকারী উদ্যোগ।
কথা বলতে না পারার কষ্ট মানুষকে মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দেয়, যার সংখ্যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক বড়, যা সীমিত মানবসম্পদের এক বিরাট অপচয়।
বিরোধী দলের ভূমিকা সংবাদপত্রগুলো কীভাবে পালন করতে পারে? সংসদের ভেতরে ও বাইরে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দল যেমন কথা বলে, সংবাদপত্রগুলোও তাদের সম্পাদকীয় ও মতামত বিভাগে তেমনিভাবে জনগণের ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সংবাদপত্রগুলো সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হলে, ‘সরকারি পত্রিকা’, ‘বিরোধী পত্রিকা’ নির্বিশেষে এই কাজটি করার কথা যদি জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানোই তাদের অভীষ্ট হয়। সম্পাদকীয় ও মতামত পড়ার সংস্কৃতিটাও গড়ে তোলার একটা পন্থা সংবাদপত্রগুলোকেই আবিষ্কার করতে হবে। একটা পন্থা হতে পারে এ রকম: একই বিষয়ের ওপর যেকোনো পত্রিকা থেকে ১০টি সম্পাদকীয় ও মতামত কলাম পড়ে সারমর্ম করে পাঠক যদি লেখা পাঠান, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তা বাছাই হবে, সেটা বিশেষ কলাম হিসেবে ছাপা হবে এবং সঙ্গে থাকবে একটি পুরস্কারও।
জনমত গঠন করার কাজটি সংবাদপত্রগুলো কমবেশি করেই থাকে। এর সঙ্গে গবেষণার কাজটিও যুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিবিসি, সিএনএন, টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ইকোনমিস্ট, গার্ডিয়ান-এর মতো উন্নত সংবাদমাধ্যম অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়, যারা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে করা গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে।
সামাজিক প্রবণতা, রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, কাজকর্ম ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এ বিষয়ে গবেষণার জন্য ইংল্যান্ডের রাষ্ট্র কাঠামোতে একটি নির্দিষ্ট বিভাগ আছে। যেখানে কাজ করেন প্রচুরসংখ্যক বিশেষজ্ঞ, যাঁরা সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ও থিঙ্কট্যাংকে এ বিষয়ের ওপর গবেষণা তো আছেই। এটা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে এ রকম কোনো বিভাগ তো নেই। তাহলে এ কাজটি কে করবে? সংবাদপত্রগুলোকেই নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ এ কাজের ভার।
ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইতালিতে শুরু হয়ে সমগ্র ইউরোপে ঘটে যাওয়া রেনেসাঁ, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের ও গ্লোরিয়াস রেভল্যুশনের মধ্য দিয়ে বিল অব রাইটস প্রতিষ্ঠা (যার প্রভাবে আমেরিকাতেও বিল অব রাইটস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), চার্চের ওপর পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য, রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথক্করণ। ১৭৮৯-১৭৯৯ কালপর্বে ফরাসি দেশে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব। রোগনির্ণয় ও আরোগ্য, আয়ু বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মৃত্যুহারের পতন, অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি, স্বাচ্ছন্দ্য তথা উন্নত আধুনিক জীবন যে শিল্পবিপ্লব সম্ভব করেছে, সেই শিল্পবিপ্লবের শিকড়ও প্রথিত ছিল উপরিল্লিখিত ওই সব ঘটনার মধ্যে অর্থাৎ ওই ঘটনাগুলো না ঘটলে শিল্পবিপ্লব কখনোই ঘটত না এবং মানবজাতির পক্ষে আজকের এই উন্নত জীবন অর্জন সম্ভব হতো না। কারণ, এই ঘটনাগুলো ব্যক্তির চিন্তার, কর্মের ও সৃজনশীলতার পথ খুলে দিয়েছিল। মানবজাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোতে সংবাদপত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথাবিরোধী দার্শনিক, সাহিত্যিক ও বিপ্লবীদের বক্তব্য সংবাদপত্রগুলোই গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
বাংলাদেশে আমরা এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ধর্ম অবমাননা আইন ইত্যাদি আইনের খড়গের নিচে বাস করছি। পান থেকে চুন খসলেই এ সব আইনের আওতায় যে কেউ মামলা করে দিতে পারেন। যাতে লেখকের বা বক্তার শাস্তি হতে পারে, জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও তো মানুষের মনন গঠনের কাজটি আমাদের করে যেতে হবে।
কোনো বৈপ্লবিক ও প্রথাবিরোধী ধ্যানধারণা মানুষের মনে সঞ্চারিত করার আগে দরকার হয় জনগণের মনন গঠনের কাজটি। নতুন ধ্যানধারণা মানুষ সহজে মানুষ গ্রহণ করে না। এ জন্যই মনন গঠনের কাজটি আগে করতে হয়, নতুন তত্ত্বের জন্য মানুষের মনকে তৈরি করতে হয়। যে কাজটি সংবাদপত্র ছাড়া সম্ভব নয়। এই কাজটা করতে অনেক বছর লেগে যায় কিন্তু ধীরে ধীরে কাজটি চালিয়ে যেতে হয়। একসময় মানুষের মন প্রস্তুত হয় এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
বাংলাদেশে আমরা এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ধর্ম অবমাননা আইন ইত্যাদি আইনের খড়গের নিচে বাস করছি। পান থেকে চুন খসলেই এ সব আইনের আওতায় যে কেউ মামলা করে দিতে পারেন। যাতে লেখকের বা বক্তার শাস্তি হতে পারে, জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও তো মানুষের মনন গঠনের কাজটি আমাদের করে যেতে হবে। তাহলে উপায় কী? উপায় নিশ্চয়ই আছে। উপায় হলো ‘লাঠি না ভেঙে সাপ মারার নীতি’। শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠন এমন হতে হবে যে আভিধানিক অর্থ দিয়ে কেউ মামলা করার সুযোগ পাবে না কিন্তু অন্তর্নিহিত বক্তব্যটা ঠিকই পরিষ্কার পৌঁছে যাবে পাঠকের কাছে।
দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে; কিন্তু কার উন্নয়ন? মুষ্টিমেয় লোকের উন্নয়ন, না সবার উন্নয়ন? ধনী-গরিবের ব্যবধানে বাংলাদেশের অবস্থান সারা পৃথিবীর মধ্যে একেবারে শীর্ষের দিকে, বসবাসের অযোগ্য হিসেবে ঢাকা শহর সারা পৃথিবীর কয়েকটি শহরের একটি, গণতন্ত্র নির্বাসনে। এই যখন অবস্থা, তখন দেশের মানুষ যাতে জেগে ওঠে, তার জন্য সংবাদপত্রগুলোকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। আমি যখন বলছি, মানুষকে জেগে উঠতে হবে। আবশ্যিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে নয়। যা দরকার, তা হলো মানুষকে তার স্বাধিকার চেতনায় উজ্জীবিত করা। স্বাধিকার চেতনায় উজ্জীবিত একজন মানুষ যে পন্থায়ই আন্দোলন করুক, সমস্যা নেই। নিশ্চয়ই সে আন্দোলন করবে, তার ইহজাগতিক উন্নয়নের জন্য আর উন্নয়ন মানেই ইহজাগতিক উন্নয়ন।
রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তনের চেয়ে সমাজ পরিবর্তন ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যে যদি উন্নত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, সে নিজেই পরিবর্তন চাইবে, যার জন্য সে-ই রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করবে, নিজেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করবে, দল গঠন করবে। এ জন্য ব্যাপক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সংবাদপত্রগুলোর উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করা দরকার। সরকার রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে, রাষ্ট্রের সব বিভাগকে যেখানে অন্যায় ও অন্যায্য সুবিধা দিয়ে, দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়ে অনুগত করে রেখেছে, সেখানে শত অনুযোগ ও হাজার সমস্যা সত্ত্বেও মানুষ রাস্তায় নামতে ভয় পায়। ভয় পায় গুম হওয়ার, মিথ্যা মামলার, জেলে যাওয়ার, চাকরি হারানোর। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী? একমাত্র উপায় হলো, মানুষের মধ্যে উন্নত জীবনের প্রতি, পরিবর্তনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করা। তা যদি করা যায়, মানুষ নিজে থেকেই পরিবর্তনের সূচনা করবে নিজের জীবনে ও অন্যের জীবনে।
শিশু, কিশোর, যুব, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষের জন্যই মনের খোরাক থাকা দরকার পত্রিকাগুলোতে। সিনেমা জগতের খবরের প্রতি যুবক-যুবতীদের স্বভাবতই আগ্রহ বেশি, কিন্তু তাঁদের এই আগ্রহ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঘুরিয়ে দিতে হবে। ঘুরিয়ে দিতে হবে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের দিকে। পৃথিবীর কোন দেশে কে জ্ঞান ও উদ্ভাবনে, কী উৎকর্ষে, কী স্বীকৃতি ও পুরস্কার পেল, উপস্থাপন করতে হবে সেই গল্প। উদাহরণস্বরূপ, মালালা ইউসুফজাই এত অল্প বয়সে কীভাবে নোবেল পেলেন, গ্রেটা থানবার্গ পরিবেশ আন্দোলনে কীভাবে একটা বিশ্ব আইকনে পরিণত হলেন। একই পাতায় সিনেমা জগতের গল্পের পাশাপাশি মহৎ মানুষের জীবনী, আবিষ্কার, বিপ্লব ও বিদ্রোহের গল্প যদি পত্রিকাগুলো পরিবেশন করা শুরু করে, ব্যাপক সাড়া জাগবে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে, ঘুরে যাবে তাদের আগ্রহ।
কোনো কোনো লেখক যেমন মধ্যবিত্তের ভাবালুতাকে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনা করে তাঁদের আরও গভীর ভাবালুতায় ডুবিয়ে দেন, সংবাদপত্রগুলোও যদি তা করে, তাহলে আর তারা দায়বদ্ধতার কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে না। আমরা জানি, সংবাদপত্রকে টিকে থাকতে হলে মুনাফা করতে হবে, সে জন্য মানুষ যে খবর পড়তে চায়, তাকে সেই খবরই পরিবেশন করতে হবে। এখানেই দরকার মুনশিয়ানা, দরকার উদ্ভাবনী ক্ষমতা। সংক্ষেপে, পাঠক যা পড়তে চান, আর আমি যা পড়াতে চাই—এই দুইয়ের ফাইন-টিউনিং করার এক জাদুকরী দক্ষতা অর্জন করতে হবে আমাদের সংবাদপত্রগুলোকে। না হলে বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com
সূত্র: প্রথমআলো।
Development by: webnewsdesign.com